মারমা উপাধি নামধারণ, লেখক - অংসুই মারমা
প্রাক-কথনঃ
অরণ্যাবৃত শ্বাপদ-সঙ্কুল দুর্গম পার্বত্য চট্টগ্রামের এ বিশাল পার্বত্য অঞ্চলে কাদের প্রথম বসতি ছিল বলা কঠিন। তবে ঐতিহাসিকদের মতে, কুকি-চীন গোত্রের শিকারজীবি কিছু অনুন্নত যাযাবর জনগোষ্ঠি এ অঞ্চলে পরষ্পর বিচ্ছিন্ন অবস্থান করত। এরা নিতান্ত বন্য স্বভাবের ছিল। কালের প্রবাহে প্রায় ১৫টি জনগোষ্ঠির বসবাসের স্থল হলেও বর্তমানে মঙ্গোলীয় শাখাভূক্ত ১১টি জনগোষ্ঠি বসবাস করে। ইংরেজ অধিকারের সময় পর্যন্ত চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্যে কোন সীমারেখা নির্দিষ্ট ছিল না। বর্তমানে সার্কেল চীফ বা রাজাগণের পূর্বসুরীরা নিজস্ব শাসন কাঠামোর আওতায় ভৌগলিকগতভাবে একটি সার্বভৌম অঞ্চলের অধিকারী ছিলেন। মধ্যযুগের আরাকান ও চট্টগ্রাম এক অখন্ড দেশরূপে ছিল। সে হিসেবে চট্টগ্রাম আরাকানী, মোগল,পাঠান শাসন আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের বসবাসরত জাতিগোষ্ঠিসমূহের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের গুরুত্ব ছিল না। বৃটিশ শাসনামলে (১৭৬১-১৯৪৭ খ্রি.) তাদেরকে একটি প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসার পর গোষ্ঠিভিত্তিক পরিচিতির গুরুত্বপূর্ণতা প্রকাশ পায়। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পৃথক জেলার মর্যাদা দেওয়ার পর ভিন্ন ভিন্ন এইসব জাতিগোষ্ঠির উপর স্বভাবত একটা ভূমিকা প্রতিষ্ঠা পায়। বৃটিশরাই প্রথম প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সামনে রেখে গোষ্ঠিগত পরিচয় নির্ণয় ও জাতিগত উপাধি ব্যবহারের পদ্ধতি প্রবর্তন করে। প্রকৃতপক্ষে কোন জাতিগোষ্ঠিরই জাতিগত উপাধি ব্যবহারের কোন রীতি প্রথা ছিল না। শুধুমাত্র তৎকালীন রাজা কিংবা নৃপতিরাই জাতিগোষ্ঠির উপর শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার লক্ষ্যে বিভিন্ন উপাধি গ্রহণ করতেন। অপরদিকে মারমাদের নামসমূহ মারমা ভাষায় চয়নকৃত বিধায় জাতিগত উপাধি ব্যবহার অনাবশ্যক। কিন্তু সময়ের নিরিখে শাসকগণের নানা পদক্ষেপ, বাংলা ভাষার প্রভাব বিস্তার, লেখ্য রীতিতে মারমা ভাষার হ্রাস পাওয়া, চাকমা ও ত্রিপুরাদের জাতিগত উপাধি ব্যবহারের প্রভাব ও স্বভাবসুলভ অনুকরণ ইত্যাদির কারণে মারমা জাতিগোষ্ঠির মধ্যেও জাতিবাচক উপাধি ব্যবহারের প্রণোদনা সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে এর ব্যবহারজনিত গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে।
আরাকানে মগ পরিচিতিঃ
চট্টগ্রামের ইতিহাসে মগ বা মঘ শব্দটি প্রাচীন। মধ্যযুগে উত্তর ভারতের মগধ রাজ্যের চন্দ্র-সূর্য্য নামক এক সামন্ত আরাকান ও চট্টগ্রাম জয় করে সেখানে রাজা হন। তাঁর সঙ্গে আগমনকারী মগধের হিন্দু-বৌদ্ধ জনগণ আরাকানের জড়োউপাসক জনগোষ্ঠির মধ্যে প্রথম ভারতীয় ধর্ম,সভ্যতা, ভাষা ও লিপি প্রচার করে। মগধ থেকে যারা গেল আর স্থানীয় যারা বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করলো তারা সবাই মাগধী বলে পরিচয় দিত। মগ বা মঘ শব্দটি মগধবাসী অর্থেই ব্যবহৃত হত। মগধ থেকে আগত অধিবাসীগণ জ্ঞানে,গুণে সমৃদ্ধ হওয়ায় উচ্চ বংশীয় হিসেবে মগ বা মঘ নামে খ্যাতি লাভ করে। এখানে ফরাসী শব্দ মুঘ (অগ্নি উপাসক) থেকে মঘ নামের উদ্ভব (আরাকানীদেরকেও অগ্নি উপাসক মনে করা হয়)। আরাকান ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের বৌদ্ধ অধিবাসীগণেরও মগ বা মঘ নামে পরিচিতি পায়। খ্রিস্টাব্দ সতেরো শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত সুদীর্ঘকালব্যাপী আরাকানীদের মগ পরিচিতি সগৌরবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। আরাকানী রাজাগণের সুবর্ণযুগে চট্টগ্রামে ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দ মঘী সন প্রচলন হয় এবং ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চট্টগ্রামে মঘী সন প্রচলিত ছিল। ইহা মারমা জাতিগোষ্ঠির নিকট প্রবিষ্ট হয়। এই মঘী সন তাদের নিকট ম্রাইমাঃ সাক্রই নামে এখনো চালু রয়েছে। বর্তমানে ম্রাইমাঃ সাক্রই ১৩৭৭। বাংলা সনের ১লা বৈশাখের ৩ দিন পর ঐ পঞ্জিকাও আরম্ভ হয় অর্থাঃ ৪ঠা বৈশাখে ম্রাইমাঃ সাক্রই এর তাইখুং মাসের ১লা তারিখ, সেই হিসেবে ১৭ই এপ্রিল ১৩৭৮ সাল শুরু হবে। ইহার বিশেষত্ব হল দিন গণনা শুরু হয় চান্দ্র মাসকে কেন্দ্র করে। চৈত্র সংক্রান্তিকে মারমা ভাষায় সাংগ্রাই বলা হয়। পরবর্তী সময়ে আরাকানী শাসকগণের নানাবিধ দুর্বলতার কারণে তাদের রাজশক্তি ক্রমান্বয়ে দুর্বলতর হতে থাকে এবং চট্টগ্রামের বহিঃশক্তির প্রভাব ও আধিপত্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। সতেরো শতকের শেষার্ধের পূর্বে অর্থাৎ হার্মাদের সাথে জুটবার আগে মঘেরা জলদস্যু ছিল বলে কোন বদনাম নেই। ওরা পর্তুগীজদের সান্নিধ্যে এসে নৌ বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠে। তারা দস্যুবৃত্তি করে হার্মাদের প্ররোচনায়। উশৃঙ্খল মঘ জলদস্যুর অত্যাচার যখন বাংলাদেশের সমুদ্রে ও নদীর তীরাঞ্চলের পরিব্যাপ্ত হয়। প্রধানত তখন থেকে চারিদিকে মগ শব্দের বদনাম ছড়িয়ে পড়ে। এমন কি তখনকার চাকমা সমাজেও মগ একটি আতঙ্কজনক নাম ছিল।
“ঘরত গেলে মঘে পায়
ঝারত গেলে বাঘে খায়
যেই যেই ভেই লক
‘সাপ্রেইকুল’ ফিরি যেই।”
(ঘরে গেলে মগ-রা আক্রমন করে, বনে পালিয়ে গেলে বাঘে খায়, যাই যাই ভাইসব সাপ্রেইকুলে ফিরে যাই)। বর্তমান আলিকদম এর চতুপার্শ্বস্থ স্থানকেই বলা হয় সাপ্রেইকুল। সাপ্রেই শব্দটি মঘী, সাঃঅর্থে চাকমা, প্রেই অর্থ দেশ। এরূপ অস্থিরতার মধ্যে চাকমারা তাদের অধিনায়ক শেরমস্ত খাঁর নেতৃত্বে ১৭৩৭ সালে সদলবলে আরাকান অঞ্চল ছেড়ে চট্টগ্রামে অনুপ্রবেশ করে। তাহলে কথিত মগদের অত্যাচার স্থল আরাকানে, চট্টগ্রামে নয়। বাঙ্গালীদের কাছেও মঘের মুল্লুক’ বলে একটি শব্দ প্রচলিত আছে। মঘের মুল্লুক হলোঃ এককথায় অরাজকতা,অমানবিকতা, ভয়াবহতা ইত্যাদি বুঝায়। আপাতত এই হল মগ সর্ম্পকিত প্রচলিত ও প্রাপ্ত তথ্যাদি। মধ্যযুগে ‘মগ’ উচ্চ বংশীয় মর্মে পরিচিতি পেয়ে থাকলে সতেরো শতকের শেষার্ধে এসে তাদের উত্তরসুরীরা জলদস্যুতার মত ভয়াবহ পেশা গ্রহণ করবে কেন? মধ্যযুগের মগদের সাথে সতেরো শতকের শেষার্ধের মগদের সাথে সম্পর্ক আছে কি? সতেরো শতকের শেষার্ধে চট্টগ্রামে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী কথিত মগদের প্রকৃত উত্তরসুরী কারা? প্রকৃতপক্ষে তারা কি পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমানের মারমাগণ? নাকি সমতলে ভূমিতে বসবাসরত রাখাইন সম্প্রদায়? নাকি বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপ? তাদেরকে কোন তত্ত্ব তালাশ করা হয়েছে? তারা ঐ সময়ে আরাকানে ফিরে গিয়েছিল? কেননা অপরাধ সংঘটনকারীগণ সংখ্যায় অল্প থাকে এবং তারা অপরাধ সংঘটনের পর গা বাঁচানোর জন্য নিরাপদ দুরত্বে পালিয়ে যায়। এইসব প্রশ্নের মীমাংসা এখনো শেষ হয়নি। যেহেতু মারমাগণ ঐতিহাসিক তথ্যাদির মাধ্যমে কথিত মগদের উত্তরসুরী নন বলে জানান দিচ্ছে। তবে প্রচলিত তথ্যের আলোকে বর্তমান লেখকগণ পূর্বেকার লেখকগণ কর্তৃক নির্ধারিত মগদের প্রতি অঙ্গুলী নির্দেশ করেন। সুতরাং এতদসংক্রান্ত এই ভাবেই গবেষণা কর্ম চলতে থাকবে।
আরাকানী রাজাগণের উপাধিঃ
আরাকানের ম্রউকও বংশীয় রাজাগণ সিংহাসনে আরোহণকালে তিন প্রকার উপাধি গ্রহণ করতেন। যথা - আরাকানী নামের সঙ্গে মুসলমানী নাম, শ্বেত-রক্ত গজেশ্বর ও সুবর্ণ প্রাসাদের অধিশ্বর। ১৪৩০ খ্রি. হতে ১৬৪৫ খ্রি. পর্যন্ত ২১৫ বছর অবধি আরাকানে ১৭ জন বৌদ্ধ রাজা আপন আরাকানী নামের সঙ্গে একটি মুসলমানী নাম উপাধি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে নরসিখহ্লা (সোলায়মান খাঁ ১৪৩০-৩৪ খ্রি.), মিনইয়াজা (ইলিশাহ্ ১৫০১-১৬১২ খ্রি.), মিনখামউং (হোসেন শাহ্ ১৬১২-২২খ্রি.), থিরিথু ধম্মা (১৬২২-৩৮ খ্রি.) অন্যতম। ১৫৯৩-১৬৪৫ খ্রি. পর্যন্ত ৫২ বছর অবধি ৫ জন রাজা মুসলমানী নামের সঙ্গে শ্বেতরক্ত গজেশ্বর উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। যেমন – মেংখামৌং (১৬১২-২২ খ্রি.) ধবল গজেশ্বর রাজা হোসেন শাহ্। ১৬৪৫-১৭৮৪ খ্রি. অবধি আরাকান রাজ্যের পতনকাল ১৩৯ বছর পর্যন্ত ২৬ জন আরাকানী রাজা উপর্যুক্ত উপাধি গ্রহণের প্রথা পরিত্যাগ করে সুবর্ণ প্রাসাদের অধীশ্বর উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। ঐ সময়ের রাজাগণ তাঁদের শাসন ব্যবস্থা সুসংহত বা রাজনৈতিক কারণে এরূপ উপাধি গ্রহণ করতেন।
ব্রম্মদেশ হতে মারমাদের আরাকানে আগমনের সম্ভাব্যতাঃ
একাদশ শতাব্দীতে ব্রম্মদেশের পঁগা রাজ অনরহট (অনিরুদ্ধ বা অনরুদ্ধ ১০১১-৪৪ খ্রি.) আরাকান, চট্টগ্রাম ও দক্ষিণ বঙ্গের এক বিস্তৃত অঞ্চল জয় করেন এবং পার্শ্ববর্তী পাট্টিকেরার রাজাকে করদানে বাধ্য করেন। রাজা অনরহটর মৃত্যুর পর ক্রমান্বয়ে পঁগা রাজ বংশের রাজা সলু, কিয়ণজিত্বা (১০৮৪ খ্রি.) ও অলংসিথু (১১২২-৬৭ খ্রি.) রাজত্ব করেন। অলংসিথু পাট্টিকেরার রাজকন্যাকে বিয়ে করেন। অতঃপর রাজপুত্র নরথু (১১৬৭-৭০ খ্রি.) রাজা হন। ডঃ আহমদ শরীফের অভিমত) পগাঁ (পুকম, অরিমর্দজর) ও পাট্টিকের রাজ্যের মধ্যে আমরা অনরহটর আমলে যে ঘনিষ্টতা দেখেছি (ডঃ আহমদ শরীফ, ১৯৭৮ইং) তাতে মনে হয় ভোট-চীনা গোত্রের লোকেরা কাছার থেকে বার্মা অবধি বিস্তৃত অঞ্চলে অনেক কাল সাংস্কৃতিক সর্ম্পক রক্ষা করে চলেছিল। বার্মার’ (তলইং বা মোন) দের (এরা মুলতঃ দক্ষিণাত্যের তেলেঙ্গ জাতির বা শ্রেণীর অস্ত্রো-এশীয় জনগোষ্ঠিই সম্ভবত আরাকান চট্টগ্রামের আদিবাসী। বারো শতকের দিকে সম্ভবত বর্মী তলইং-মোন গোষ্ঠির মানুষেরা আরাকানে অনুপ্রবেশ করে।
উপরোক্ত তথ্য থেকে স্পষ্ট হচ্ছে না যে আরাকান থেকে তাদের বংশধরেরা চট্টগ্রামে প্রবেশ করেছে। হিসেবে দেখা যায় যে, অনরহট রাজবংশ ১০১০-১১৭০ খ্রি. পর্যন্ত ৬০ বছরব্যাপি চট্টগ্রাম শাসন করেছিল। তাঁর সাথে আগত জনগণের একটি অংশ চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসতির জন্য ঐ সময়ে প্রবেশ করে থাকতে পারে। কিন্তু এই সম্ভাবনার পক্ষে যথেষ্ট তথ্য উপাত্ত এই পর্যন্ত প্রকাশ পায়নি। এখানে মারমাদের চট্টগ্রাম কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রামে অভিবাসনের সময়কাল নিয়ে সন্দেহ দূরীভূত হয় নি। বোমাং ইতিহাস মতে, তৎকালীন পেগুর বার্মায় রাজার বংশধর মংচপিঁয়ো আরাকান রাজার অধীনে চট্টগ্রামের শাসনকর্তা ১৬১৪ খ্রিস্টাব্দে নিযুক্তির সূত্রে বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রামে মারমাদের পূর্বপুরুষগণ চট্টগ্রাম থেকে প্রবেশের আভাস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের মারমাদের একটি অংশ দৃঢ়ভাবে মনে করেন যে, তার বহু পূর্ব থেকেই তারা চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে ছিলেন। যেমন- চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানাধীন চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের গশ্চি-নোয়াহাট নামক বাজার হতে সৌজা দক্ষিণে কর্ণফুলী নদীর তীরে লম্বুর হাট নামে একটি বাজার অদ্যাবধি আছে। এ লম্বুর হাটের প্রকৃত নাম লংবোজিঃ। এটি মারমা শব্দ। লং অর্থ নৌকা, বো অর্থ প্রধান মাঝি ও জিঃ অর্থ বাজার। এটা মারমাদের বাজার ছিল একসময়। আরও এক তথ্য হলো - নোয়াপাড়া এর পূর্বনাম হলো - নোয়াবাং (গোচারন ক্ষেত্র), এটি মারমা শব্দ। কেউপাড়া (কিউবাং বা মহিষচারন ক্ষেত্র), রাঙ্গুনিয়ার রোয়াজা জিঃ (রোয়াজার হাট)। অবশ্য এসব বিষয়ে অধিকতর অনুসন্ধান করতে খাগড়াছড়ি সদরে অবস্থিত সামাজিক সংগঠন মারমা উন্নয়ন সংসদ এর আর্থিক ব্যবস্থাপনায় প্রফেসর মংসানু চৌধুরী ও সাবেক সুগ্ম-সচিব উক্যজেন যৌথভাবে গবেষণা কর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। অচিরেই আমরা ইতিহাসের এক পথ সন্ধান পাব। তাঁরা উভয়েই খাগড়াছড়ি জেলার কৃতি সন্তানরূপে বিবেচিত।
মারমা প্রধান বোমাং রাজার ঐতিহাসিক পটভূমিঃ
তৎকালীন বার্মার হাইসাওয়াদ্দি রাজ্যের পেগু আরাকান রাজা মিনইয়াজাগ্যি (১৫৯৩-১৬১২খ্রিঃ) কর্তৃক ১৫৯৯খ্রিঃ পতন হলে পেগুর রাজপুত্র মংচপিয়ো সদলবলে দাঙাওয়াদ্দি তথা আরাকানে নীত হন। রাজা মিনইয়াজাগ্যির মৃত্যুর পর তাঁর জ্যৈষ্ঠ পুত্র মেংখামৌং (১৬১২-২২ খ্রি.) আরাকানের রাজা হন। তাঁর আমলে চট্টগ্রামে বঙ্গোপসাগরসহ উপকুলবর্তী এলাকায় অরাজকতা দেখা দেয়। চট্টগ্রামের শাসনকর্তা তাঁর ভ্রাতা আনাপোড়ন গোলযোগ নিরসনে ব্যর্থ হচ্ছিলেন। তাই জলদস্যু দমনসহ বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করতে পেগুর রাজপুত্র মংচপিঁয়োকে ১৬১৪ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের শাসনকর্তা নিয়োগ দেন। তিনি দক্ষতার সাথে অভিযান সফল করেন বিধায় আরাকান রাজা কর্তৃক ১৬২০ খ্রিস্টাব্দে বোমাং উপাধিতে ভূষিত হন। পরবর্তী সময়ে আরাকানের মহাদন্ডায়ো নামে জনৈক সামন্ত আরাকানের রাজা হন এবং তিনি চন্দউজিয়া (১৭১১-৩১খ্রি.) নাম ধারণপূর্বক সিংহাসনে আরোহণ করেন। ঐ সময়ে আরাকানে ও বঙ্গোপসাগর এবং উপকুলীয় দ্বীপসমূহে মঘ ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের উৎপাত হতে নিস্কৃতি পেতে বোমাং মংচপিঁয়োর বংশধর হেরিও (হেরিঞো)কে ১৭১০ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের পশ্চিমে অভিযান পরিচালনা করতে পাঠান এবং অভিযান সফল হওয়ার পর তিনি আরাকানের রাজ কর্তৃক বোমাংগ্রী উপাধি পান। ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পচাঁশি বৎসরকালে চট্টগ্রাম একাধিক্রমে আরাকানের শাসনাধীন ছিল। মোগল বাহিনী ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে ২৭ জানুয়ারী উত্তর চট্টগ্রাম অধিকার করেন (মোঃ ইসহাক চৌধূরী, ফতেহ নগর, রাউজান)। ফলে চট্টগ্রামের আরাকানী শাসনকর্তা বোমাংগ্রী হেরিংঞো এর আমলে আরাকানী শাসনের অবসান হয়। কিন্ত শঙ্খনদের দক্ষিণ তীরবর্তী চট্টগ্রামের দক্ষিণাংশ আরাকানের অধীনে হেরিংঞো এর শাসনে থেকে যায়। অর্থাৎ শঙ্খ নদের উত্তরে সুরে বাংলা ও দক্ষিণে আরাকান অধিকারের সীমানা নির্ধারিত হয়। ১৭২৭ খ্রিস্টাব্দে কংহ্লাপ্রু আরাকান অধিকৃত দক্ষিণ চট্টগ্রামের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে দোহাজারী দুর্গের সেনাপতি আধুখাঁ অথবা তৎপুত্র শের জামাল খাঁ আরাকানীদের বিতারিত করে দক্ষিণ চট্টগ্রামকে সুবেবাংলার অর্ন্তভূক্ত করেন। ফলে বোমাং কংহ্লাপ্রুকে তাঁর দপ্তর বান্দরবান এলাকায় স্থানান্তর করতে হয়। অপরদিকে চট্টগ্রামে মোগলদের সাথে ইংরেজদের ক্ষমতার লড়াই চলতে থাকে এবং ‘চট্টগ্রামের শেষ মুসলিম শাসনকর্তা নবাব মীর মোহাম্মদ রেজা খাঁ ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ চীফ হ্যারী ভেরলস্টকে শাসনভার বুঝিয়ে দেন। এতদাঞ্চলের বৃটিশ সরকারকে ক্ষমতা সংহত ও সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ করতে সময় নিতে হয়। ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে হতে ৪৮ বছর যাবৎ বোমাংগন বান্দরবানে স্বাধীন ছিলেন। ১৮২২খ্রিস্টাব্দে বৃটিশের অধীনতা মেনে নেন। ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে বোমাং কংহ্লাপ্রু বান্দরবানের সোয়ালক নামক স্থানে বৃটিশ গবেষক ফ্রান্সিস বুকাননের সাথে সাক্ষাৎকালে এই জনগোষ্ঠির পরিচয় দিয়েছিলেন মা-রা-মা হিসেবে।
উল্লেখ্য যে, ১৬১৪ খ্রিস্টাব্দে বোমাং মংচপিঁয়োর চট্টগ্রামের শাসনকর্তা (গর্ভণর) নিয়োগ প্রাপ্তির সুবাদে বোমাং অনুসারিগণ বিভিন্ন সময়ে কর্ণফুলী নদী ও শঙ্খ নদ ধরে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ করা যায় যে, মারমা শব্দটি ব্রম্মদেশের তেলেইং ভাষার মেয়ামা শব্দের বিবর্তিত রূপ। একাদশ শতকে তেলেইং রাজার মুদ্রাসূত্রে জানা যায় যে, তেলেইংদের প্রাচীন নাম ছিল মেয়ামা। ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে আরাকান রাজা কর্তৃক পদানত পেগুর রাজ পুত্রকে আরাকানে নেওয়ার সময়ে কয়েক হাজার মেয়ামা গোত্রের তেলেইং সৈন্যকেও বন্দী করে নিয়ে আসা হয়। মেয়ামারা আরাকানে মারমা নামে খ্যাত হয় এবং পরবর্তীতে তাদেরকে আরাকানী সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। উপরোল্লিখিত তথ্যাদি মোতাবেক অনুমেয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত মারমা জনগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষরা হলো পেগু থেকে আগত জনগণের অংশবিশেষ, তারা আরাকানে মূল বৌদ্ধ জনগোষ্ঠি নন।
জাতি গোষ্ঠীগত পরিচিতিঃ
জাতিগোষ্ঠীগত পৃথক পরিচিতির বিষয়টি মোগল আমলেই (১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দেন পর) দৃশ্যমান হয়। চট্টগ্রামের মুসলিম শাসন অবসানের পর ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজরা অধিকার করে। বৃটিশ শাসকগণ পার্বত্য অঞ্চলকে প্রশাসনিক ইউনিটে এনে সার্কেল পদ্ধতি প্রবর্তন করে। যথা – চাকমা সার্কেল, বোমাং সার্কেল ও মং সার্কেল নামে ৩টি সার্কেলে ভাগ করে ঐতিহাসিক ও অন্যান্য দিক বিবেচনা করে তাদের পদমর্যাদা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রামে ৩০০ এর অধিক মৌজা সৃষ্টি করা হয়েছিল ও সরকার কর্তৃক মৌজা হেডম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়। চাকমাদের দেওয়ান পদ ও মারমাদের ঐ জাতীয় পদগুলো লুপ্ত হয়ে যায় এবং স্বভাবতই পূর্বের দেওয়ান ও তাদের পুত্ররাই হেডম্যান হয়েছিল। মৌজার অধীন গ্রাম প্রধানকে চাকমাদের কারবারী এবং মারমা ও অন্যান্য উপজাতীয়দের রোয়াজা বলা হয়ে থাকে। গ্রাম প্রধানকে ত্রিপুরাদের নারান, মারমাদের রোয়াজা বলা হয়। তবে পরবর্তীতে ত্রিপুরা হেডম্যানদের ক্ষেত্রে রোয়াজা উপাধি ধারণ করতে দেখা যায়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগলিকগত বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ চিটাগাং হিলট্রাক্টস্ রেগুলেশন এক্ট প্রণয়ন করে, যা পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি হিসেবে পরিচিতি পায়। বৃটিশ সরকার পার্বত্য রাজাগণকে সার্কেল চীফ পদ মর্যাদা দিয়ে কর আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। মূলত তাদের স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের সূচনা করা হয় এবং জাতিগোষ্ঠীর পরিচিতি ও প্রচারণার ক্ষেত্র নির্ণীত হয়। বৃটিশ সরকার প্রধানত সামাজিকভাবে ৪টি শ্রেণীতে বিন্যাস করে। যেমন -
১। সার্কেল চীফ (রাজা)- বৃটিশ সরকারের পক্ষে খাজনা উশুলকারী/সমাজপতি।
২। হেডম্যান – চীফ এর অধীনস্থ মৌজা প্রধান ও খাজনা আদায়কারী/মৌজার বিচারক।
৩। কারবারী – হেডম্যানের অধীনস্থ গ্রাম প্রধান/গ্রামের বিচারক ও শৃংখলা রক্ষাকারী।
৪। সাধারণ প্রজা।
মারমা উপাধি ব্যবহারের পটভূমিঃ
সংস্কৃতিগতভাবে মারমা জনগোষ্ঠীর নাম চয়ন করা হয় ম্রাইমা ভাষায়, বাংলা ভাষায় কিংবা অন্য ভাষাও নয়। নামে সাধারণত ৩টি সিলেবল্ থাকে। যেমন -‘ওয়াইংম্রাচিং’ নাম দেখেই বলা যায় যে, তিনি মারমা জাতির। পৃথক পরিচিতির জন্য মারমা শব্দ ব্যবহারের প্রয়োজন পড়েনি। অন্যান্য ভাষাভাষীদের নিকট মারমাদের নামসমূহ অনেকক্ষেত্রে দুর্বোধ্য ঠেকে। মারমাগণের নামসমূহ অনেকক্ষেত্রে অন্য ভাষায় সঠিক উচ্চারণ, ধ্বনি সৃষ্টি কিংবা লেখা অবিকৃতভাবে তৈরী করা যায় না। মারমা ব্যতীত অন্যান্যরা পুরুষ ও মহিলার নাম সাধারণত পৃথক করতে পারেন না। চাকমা ও ত্রিপুরার মত মারমাও একটি জাতিবাচক শব্দ। মারমা সমাজে নামের সাথে জাতিবাচক শব্দ ব্যবহৃত হত না । মারমা শব্দ যুক্তকে ব্যাকরণসম্মত নয় ও অপ্রাসঙ্গিক হিসেবে ধরা হত। পূর্বে চাকমা ও ত্রিপুরাগণেরও জাতিবাচক শব্দ ব্যবহৃত হত না। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীগণ ত্রিপুরা উপাধি ব্যবহার করেন না। পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা ও ত্রিপুরাগণের নাম হিন্দুদের অনুরূপ বাংলায় চয়নকৃত হওযায় পৃথক পরিচিতির জন্য বৃটিশ আমলে (১৭৬১-১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ) চাকমা ও ত্রিপুরা শব্দ ব্যবহারের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই সমস্যা মারমাদের ছিল না। ঊনিশ শতকের আরম্ভ ও পাকিস্তান আমলে (১৯৪৭-৭১ খ্রিস্টাব্দ) রাষ্ট্রীয় কাজের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় চাকমা ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর নামের সাথে উপাধি (চাকমা ও ত্রিপুরা) ব্যবহারের গুরুত্বপূর্ণতা ও আবশ্যকতা দেখা দেয়।
সরকারী বিভিন্ন রেকর্ডপত্রে বিশেষত রাঙ্গামাটিতে প্রশাসনিক দফতরের কর্মচারীদের দ্বারা চাকমা ও ত্রিপুরাদের অনুরূপ মারমাগণের নামের শেষে এককালে মগ যুক্ত করা হত। চাকমা ও মং সার্কেলের মারমাদের নামে এ মগ উপাধি ব্যবহারের যথেষ্ট প্রভাব পড়েছিল এবং এ প্রভাব এখনো রয়ে গেছে। অপরদিকে ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে জাতিগত পরিচয় মারমা অভিধা স্বীকৃত হওয়ার পরেও নজির না থাকায় বোমাং সার্কেলভূক্ত মারমাদের শুধু মাত্র নামই বজায় থাকত, মারমা শব্দ ব্যবহৃত হত না। দ্বিতীয়ত বোমাং রাজার পক্ষে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় বৃহত্তর মারমা সমাজের মারমা অভিধা স্বীকৃতি পাওয়ার প্রচারণা পায়নি। অন্যদিকে মারমাদের অর্থনৈতিক তাড়না না থাকায় আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ অর্থাৎ উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের হার খুব কম ছিল। রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থার কারণে তারা চাকুরীও করত না। মানসিক চাহিদাও ব্যাপক ছিল না এবং গ্রামে মাটি কামড়ে থাকার নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। তবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক লেভেল পর্যন্ত উন্মুক্ত ছিল। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর মারমা সমাজের চিত্র বদল হতে শুরু করে। তখন তাদের সমাজেও শিক্ষা প্রসারের একটা ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় বলা যায়। এখানে টার্নিং পয়েন্ট হল যে, রায় সাহেব থোয়াইপ্রু চৌধুরী কর্তৃক ১৯৫৬খ্রিস্টাব্দে কাপ্তাই উপজেলাধীন নারানগিরি পাইলট হাই স্কুল নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়, যা মারমাদের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সিঁড়ি হিসাবে পরিগণিত হয়। শিক্ষা প্রসারে উক্ত স্কুলের ভূমিকা ছিল খুবই প্রসংশনীয়। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে উক্ত স্কুল থেকে রায় সাহেবের স্মরণে একখানি স্মরণিকা প্রকাশিত হয়। উক্ত স্মরণিকা প্রকাশনা কমিটিতে ২ জন মারমা ছাত্র ছিলেন এবং স্মরণিকায় তারাই সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে নামের শেষে মারমা উপাধি ব্যবহার করেন। তারা হলেন - আথোয়াই মারমা (ডলুছড়ি নিবাসী) ও মংচিনু মারমা (নারানগিরিমুখ নিবাসী)। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাঙ্গামাটি আসনের চাকমা জাতিগোষ্ঠীর প্রার্থী মানবেন্দ্র নারায়ণ তাঁর গোষ্ঠীর (গঝার) নাম “লারমা” যুক্ত করে অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা এর নামে অংশ নিলে চন্দ্রঘোনা এলাকার মারমা শিক্ষার্থীরাও নিজেদের অজান্তে মারমা উপাধি ব্যবহারের জন্য অনুপ্রাণিত হয়ে উঠে। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়, চট্টগ্রাম বেতার থেকে প্রচারিত অনুরোধের আসরে মারমা ছাত্র/যুবাগণ মারমা শব্দ যুক্ত করে নাম লিখতে শুরু করে। মানবেন্দ্র যদি নামের শেষে লারমা লিখতে পারেন, মারমা হয়েও আমরাও কেন মারমা লিখতে পারব না? উক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ নিয়ে আলোড়ন উঠে। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে নবম শ্রেণীর মারমা ছাত্র/ছাত্রীরা সিদ্ধান্ত নিল যে, তারা এস, এস, সি, পরীক্ষার রেজিষ্ট্রেশনের সময় নামের শেষে মারমা উপাধি লিখবে এবং উঠেই তারা তাই করল। উক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে যেসব মারমা ছাত্র-ছাত্রী ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে এস, এস, সি পাশ করেছে, তারাই প্রতিষ্ঠানিকভাবে সর্বপ্রথম মারমা শব্দযুক্ত নাম ব্যবহার করেছে। নজির না থাকা সত্ত্বেও তারাই প্রথম নজির ভেঙ্গে মারমা উপাধিযুক্ত লেখার ইতিহাস সৃষ্টি করলো। ঐ ব্যাচের ছাত্র/ছাত্রীদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, লেখালেখি, যোগাযোগ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সরব উপস্থিতি থাকায় রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মারমা শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরে বেশ প্রভাব ও প্রচার পায়। তাদের পূর্বে কেউ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মারমা যুক্ত নাম লিপিবদ্ধ করেনি। দুই তিন বছরের মধ্যে চাকমা ও মং দুই সার্কেলের মারমাগণ অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত হয়ে মগ শব্দের পরিবর্তে মারমা শব্দ যুক্ত নাম লেখার আন্দোলন শুরু করে। পরবর্তীতে খাগড়াছড়ি সদরে ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে ‘মারমা উন্নয়ন সংসদ’ নামে একটি বৃহৎ সামাজিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মূলত তখন থেকে খাগড়াছড়ি জেলার মারমা শিক্ষার্থীরা মারমা যুক্ত নাম লিপিবদ্ধ করে। অবশ্য তাদের পূর্ব থেকে বিক্ষিপ্তভাবে নামের সাথে মারমা উপাধি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বাঙ্গালীরা মনে করেন যে, যেহেতু চাকমা ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর নামের সাথে ত্রিপুরা ও চাকমা লেখা থাকে, তাই মারমাদেরও অনুরূপ থাকা উচিত। আশির দশকের পর খাগড়াছড়ি জেলার মারমা জনগোষ্ঠীর মারমা উপাধি ব্যবহারের লোকপ্রিয়তার সাথে সাধারণের মধ্যে একটা রেওয়াজে পরিণত হয়। আবার অনেকে নানাভাবে বিরম্ভনার মুখেও পড়তে হয়েছিল। নব্বইদশকে মারমা উপাধি ব্যবহারের জনপ্রিয়তা খাগড়াছড়িতে এমনভাবে বৃদ্ধি পায় যে, বাঙ্গালী শিক্ষকরাও এ বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠেন। অপর দিকে বান্দরবান সদরস্থ মারমা সম্প্রদায়ভূক্ত কিছু রক্ষণশীল শিক্ষক মারমা উপাধি ব্যবহারের উপর বিপরীত অবস্থান নেন। এ নিবন্ধকার চাকুরীর বদলীসূত্রে খাগড়াছড়ি হতে বান্দরবান সদরে যান এবং তাঁর এক সন্তানকে একটি কে. জি. স্কুলে ভর্তি করান। সন্তানের নামের সাথে ‘মারমা’ লেখার জন্য বার্ষিক পরীক্ষায় ১টি বিষয়ে ১ নম্বর কর্তন করা হয়। পরবর্তী সময়ে বদলী হয়ে আবার খাগড়াছড়ি গেলে বান্দরবানস্থ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্র অনুযায়ী সন্তানকে একটি স্কুলে ভর্তি করা হয়। সেখানে নামের শেষে মারমা না লেখার জন্য বার্ষিক পরীক্ষায় একটি বিষয়ে প্রাপ্ত নম্বর থেকে ১ নম্বর কর্তন করা হয়েছিল। অবশ্য পরে মারমা শব্দ যুক্ত করা হয়। এমন বিপাকে কারো পড়তে হয়েছিল কিনা জানি না তবে বর্তমানে তা কেটে গেছে। নামের শেষে মারমা ব্যবহারের বিষয়টি বর্তমানে রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। পূর্বে অপ্রাসঙ্গিক মনে করা হলেও পরবর্তীতে গ্রহণযোগ্যতা ও প্রাসঙ্গিকতা পায় এবং নব্বই দশকে মাঝামাঝি হতে বোমাং সার্কেলের মারমারাও মারমা উপাধি ব্যবহার আরম্ভ করেন। বান্দরবান সদর এলাকায় সংস্কৃতি ও রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থাগত কারণে মারমা উপাধি ব্যবহারের রেওয়াজ একসময় অপাঙক্তেয় ছিল। কিন্তু খাগড়াছড়ির রেওয়াজ বান্দরবান সদর ছাড়িয়ে রুমা, থানচি, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি, রোয়াংছড়ির মত মারমা অধ্যুষিত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।
মারমা উপাধি ব্যবহারঃ
ঐতিহাসিকভাবে কেবলমাত্র আরাকানে রাজাগণ বিভিন্ন উপাধি গ্রহণ করতেন। সাধারণ আরাকানিদের কোন উপাধি ছিল না। মারমা প্রধান তৎকালীন চট্টগ্রামে শাসনকর্তা মংচপিঁয়ো ১৬২০ খ্রিস্টাব্দে বোমাং উপাধি পেয়েছিলেন। বর্তমানে মংসার্কেলের প্রধান মং রাজার পূর্ব পুরুষ কিঞোকে আরাকানি রাজা নাগাথোয়াইখিন কর্তৃক ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে সোর্ডম্যানশিপ ‘ধাবইং’ উপাধি দেওয়া হয়েছিল। মারমা সমাজ প্রধান বোমাং মেং-স-পিউ/মেংচপ্যাই এর বংশধর হেরিও (হেরিঞো) আরাকান রাজ চন্দ্র উজিয়া কর্তৃক ১৭১০ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের পশ্চিমে অভিযানে সহযোগিতার জন্য বোমাংগ্রী উপাধী পান। মোগল আমলে চাকমা রাজাগণও মুসলিম নাম ধারণ করতেন। যেমন: শেরমন্ত খাঁ (১৭৩৭ খ্রিঃ), জানবক্স খাঁ (১৭৮২ খ্রি.), ধরম বক্স খাঁ (১৮১২ খ্রি.) ইত্যাদি। তখন রাজা ও প্রজারূপে সমাজ বিভাজিত ছিল। সাধারণ মারমাদের নামের কোন উপাধি ছিল না। উপাধি ব্যবহারের নজিরও সৃষ্টি হয়নি।
চাকমা, ত্রিপুরা, খিয়াং, মুরং, চাক ইত্যাদি জনগোষ্ঠীরও কোন উপাধি ছিল না। বিশিষ্ট জনদের সাথে আলোচনা করে এমন জানা গেছে। ১৭১১ খ্রিস্টাব্দে আরাকান রাজ চন্দ উজিয়া সম্ভবত: চাকমা রাজ চন্দন খাঁকে তাঁর পূর্ব আনুগত্যের সূত্রে ‘তৈনখান’ খেতাব দেন। ২২ বৃটিশ কর্তৃক বাংলাদেশ অধিকৃত হওয়ার পরে জমিদারী প্রথা চালু করে কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে জমিদারী প্রথা চালু না করে সার্কেল পদ্ধতি প্রবর্তন করে চীফ বা রাজাগণের অধঃস্তন হেডম্যান পর্যায়ের কিছু প্রভাবশালী মারমাকেও রায় সাহেব, রায় বাহাদুরসহ চৌধুরী উপাধি প্রদান করে। এরূপ উপাধি প্রাপ্তরা হলেন- চন্দ্রঘোনার রায় সাহেব থোয়াইপ্রু চেীধুরী, খাগড়াছড়ি রায় বাহাদুর রেম্রাচাই চৌধুরী, রামগড়ের রায় বাহাদুর কংজপ্রু চৌধুরী প্রমুখ। ‘চাকমা রাজা হরিশ চন্দ্র রায় বাহাদুর খেতাব পেয়ে ছিলেন ১৮৭৩খ্রিস্টাব্দে। পরবর্তীকালে প্রয়াত বোমাং রাজা মংশুয়েপ্রু ও প্রয়াত বোমাং রাজা অংশৈপ্রুও চৌধূরী উপাধি গ্রহণ করেন। মং রাজ পরিবারের কোন সদস্যই চৌধুরী উপাধি গ্রহণ করেননি। ইংরেজ শাসনের সময়ে বোমাং সার্কেলভূক্ত কিছু ব্যক্তি নামের আগে মং উপাধি লেখার রেওয়াজ সৃষ্টি করেন। যেমন - প্রয়াত মং সাহ্লাপ্রু, কল্যান কর্মকর্তা, বান্দরবান জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। প্রয়াত মং সাম্রাঅং, কাপ্তাই উপজেলার ডংনালা প্রাথমিক বিদ্যালয় এর প্রধান শিক্ষক। মং অংসাপ্রু, (অব:) প্রধান শিক্ষক, সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়, কাপ্তাই উপজেলা। ডা. মং উষাথোয়াই, প্রাক্তন আর. এম. ও. বান্দরবান সদর হাসপাতাল। তাঁরা তখনকার সময়ে হিন্দু বাঙ্গালী ও ত্রিপুরাদের ‘শ্রী’ ব্যবহারের অনুরূপে নামের পূর্বে ‘মং’ শব্দ লিখতেন। মং বার্মিজদের সাধারণ উপাধি বলে জানা যায়। ফলে বার্মিজ প্রচলিত উপাধি তাঁরা অনুসরণ করে থাকতে পারেন। অথবা মং সার্কেলের মং রাজাকে অনুসরণ করে এরূপ উপাধি ব্যবহার করে থাকতে পারেন। তবে মং চীফের পূর্ব নাম ছিল ‘মান’। এ মান সার্কেলের প্রধান পুরুষ কংজয় ধাব্বইং ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তথা বৃটিশ সরকারের অনুকূলে কার্যক্রম পরিচালনা করায় মান করেই বৃটিশ সরকার মান সার্কেল প্রতিষ্ঠা করে তাঁকে সেখানে নিয়োজিত করার কথা প্রচলিত আছে। পরবর্তীতে যে কোন কারণে ‘মান’ এর স্থলে সার্কেলের নাম ‘মং’ হয়ে যায়। মং অর্থ সুপুরুষ, সাধারণ অর্থে ভাই বুঝায়। চাকমা চীফের অধ:স্থন ব্যক্তিদের উপাধিসমূহ-দেওয়ান (মোগল আমলে প্রবর্তিত), তালুকদার (চাকমা রানী কালিন্দী কর্তৃক প্রবর্তিত), খীসা (আরাকান আমলে প্রবর্তিত)। খীসা আরাকানী শব্দ কিইজা এর বিবর্তিত রূপ। সাধারণভাবে মারমারা হরিণের মাংসকে ‘খীসা’ বলে। ‘ত্রিপুরা’ জনগোষ্ঠীর উপাধি রোয়াজা (হেডম্যান পর্যায়ভূক্ত), পাড়া প্রধান কার্বারীর অনুরূপ বোমাং কর্তৃক নিযুক্ত রোয়াজা কিংবা ধামাই বা ফাইন্সি অথবা কালুদাক পদ সৃষ্টি করা হয়েছিল।
বোমাং সার্কেলের আওতাভূক্ত মারমাগণ বোমাং সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত। বংশানুক্রমে যিনি বোমাং হন তিনিই এই উপাধি ধারণ করেন। বংশের অন্য সদস্যগণ উক্ত উপাধি গ্রহণ করতে পারেন না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া অন্যদের উপাধি ধারণের কোন ঐতিহ্য না থাকায় বান্দরবানের কোন হেডম্যান কিংবা বাজার চৌধুরীও চৌধুরী উপাধি ধারণ করেননি। এমনকি চৌধুরী উপাধি গ্রহণকারী দুইজন বোমাং রাজার বংশধরেরাও চৌধুরী উপাধি যেমন - বোমাং রাজা মংশৈপ্রু চৌধুরীর পুত্র মংঙয়েপ্রু, নুমং প্রু, বোমাং রাজা অংশৈপ্রু চৌধুরীর পুত্র চহ্লাপ্রু (জিমি), সাচিংপ্রু (জিরি) ইত্যাদি। তবে সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মংক্যচিং চৌধুরী কিসের ভিত্তিতে চৌধুরী উপাধি ধারণ করেছেন তা পরিষ্কার নয়। চন্দ্রঘোনার স্বনামখ্যাত রায় সাহেব থোয়াই প্রু চৌধূরীও বোমাং সার্কেলের একজন হেডম্যান ছিলেন।
(প্রতিপাদ্যটি এখানে প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় আলোচনা-পর্যালোচনার জন্য উপস্থাপনার প্রয়াস।)
Comments
Post a Comment