মারমাদের ব্যক্তিক নামকরণের রীতিনীতি

 মারমাদের দিনক্ষণ, লগ্ন ও বয়োজ্যেষ্ঠতাকে নিয়ে নামকরণের রীতি আছে। আছে সেই নামের অর্থও। এবং কোন ব্যক্তি যে দিনে জন্মগ্রহণ করেছে, সেই জন্মবার জেনেই ওই ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো আন্দাজ করা যায়। শুধু তাই নয়, সেই জন্মবারের গুরুত্ব আছে কোন ঘর-বাড়ী বানাতে এবং কোন নতুন গাছ লাগাতে বা চারা রোপন করতে কিংবা কোন চাষাবাদ শুরু করতে। এমনকি বিয়ে করতেও দুজন ব্যক্তির মধ্যে জন্মবারের মিল (প্রিয়যোগ বা মরণযোগ) দেখা হয়। সুতরাং নামেই কতকিছু প্রথা ও রীতিনীতি জড়িয়ে আছে! যেগুলো অন্য কোন সম্প্রদায় বা জাতিতে আছে কিনা জানি না। 


যদি কেউ বৃহস্পতিবারে জন্মগ্রহণ করে, তাহলে তার নামের মধ্য সিলেবলটি 'প, ফ,ব,ভ,ম' (বাংলায় তর্জমা করে) হবে। মারমাদের নামের সিলেবল সাধারণত তিনটি হয়। যেমন, রা-ফ্রু-সেইং, মং-ফ্রু-সেইং, ক্য-বা-মং, ক্য-মং-চিং ইত্যাদি। (যদিওবা কারো কারো নামের সিলেবল দুটিও হয়।) এছাড়াও যদি কেউ ভোরে বা একদম সকালে জন্মগ্রহণ করে, তাহলে তার নাম হতে পারে পেইং-ম্রা-চিং, হ্রুই-ম্রা-চিং, তা-নিং-মং ইত্যাদি। যদি বিকেলে বা রাত্রে জন্মগ্রহণ করে, তাহলে তার নাম হতে পারে খেং-মং-চিং বা নিং-খেং-মং ইত্যাদি। যদি পিতামাতার বড় ছেলে হয়, তাহলে তার নাম হতে পারে (প্রথম সিলেবল 'উ' দিয়ে) উ-প-চিং, উ-মং-চিং আর যদি পিতামাতার ছোট সন্তান হয়, তাহলে হতে পারে (প্রথম অক্ষর 'থুই' দিয়ে) থুই-ম্রা-সং, থুই-মং-চিং ইত্যাদি। অর্থাৎ যদি যথাযথ রীতিনীতি অনুযায়ী নামকরণ করা হয়, তাহলে একটা নাম দিয়ে আমরা ওই ব্যক্তির জন্মবার, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, বড় ছেলে নাকি কনিষ্ঠ ছেলে কিংবা কখন জন্মগ্রহণ করেছিল, এসব জানতে পারি।


সাধারণ গৃহীদের নামকরণের ক্ষেত্রে মধ্য সিলেবলের গুরুত্ব আছে। অন্যদিকে ভিক্ষুদের নামকরণের ক্ষেত্রে প্রথম সিলেবলের গুরুত্ব আছে। তাই কারো কারো নাম ভান্তে বা ভিক্ষুদের নামকরণের নিয়ম অনুসারে হয়। এর পেছনে একটা যুক্তি আছে। সাধারণত ছোটকালে কেউ কেউ দীর্ঘ সময় ধরে অসুস্থ হয় বা রোগে ভোগে। তাই রোগমুক্তির আশায় কোন কোন ছেলে বা মেয়েকে কোন ভান্তে বা ভিক্ষুর নিকট দান করা হয়। তখন ভান্তে বা ভিক্ষু আগের গৃহী নাম বাদ দিয়ে ভান্তে নামকরণের রীতি অনুযায়ী বা পছন্দমতো নামকরণ করে। পরে যখন রোগমুক্ত হলে, তখন আবার ভান্তের কাছ থেকে কিনে নেওয়া হয়। তার সেই ভান্তের দেওয়া নামটি থেকে যায়।


শুধুমাত্র পোষাক পরলেই আদিবাসী হয় না। আদিবাসী টার্মে বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে সাংস্কৃতিক বৈচিত্রতা, যেগুলো মেইনস্ট্রিম জনগোষ্ঠী থেকে ভিন্ন। এ যে নামকরণের রীতি, ছোট ছোট ছোট রোগমুক্তির বিশ্বাস, শান্তিতে থাকার ধর্ম, মায়ের ভাষা, বংশপরম্পরায় চলে আসা রীতিনীতি, প্রথা, ঐতিহ্য ও চর্চা, এগুলোই তো আমাদের সংস্কৃতি। পুরো জন্ম থেকে মৃত্যুর পরেও শেষকৃত্য পর্যন্ত আমাদের যে জীবনাচরণ, বিশ্বাসগুলো রয়েছে, সেগুলোর কারণেই তো আমরা মারমা। সেগুলোর কারণেই আমরা আদিবাসী হিসেবে দাবি করতে পারি। এখন যদি আমরা এসব ধারণ, লালন-পালন ও চর্চা না করি, তাহলে আমরা আর মারমা না। আদিবাসীও না। সংকর, উপজাতি বা প্রভাবিত কিংবা আত্তীকৃত একটা জাতি হিসেবে পরিচয় দিতে পারি।


.......................................

বাঙালি সমাজে দেখেছি, বাবার নাম থেকে একটা বা দুটা অক্ষর আর মায়ের নাম থেকে একটা বা দুটা অক্ষর মিলে তাদের সন্তানের নাম রেখে দিচ্ছে। ইদানীং দেখছি, নামকরণের ক্ষেত্রে মারমারা বংশপরম্পরায় প্রথা ও রীতিনীতিগুলো পালন করছে না। অনেকেই নিজের ইচ্ছেমতো বা বাঙালি সমাজের মতো ছেলে-মেয়েদের নামকরণ করে যাচ্ছে, যা পুরোপুরি প্রচলিত প্রথা ও চর্চার বিরোধী ও বিকৃত রুপ।


ছেলে-মেয়েদের নামকরণের অধিকারটা একান্তই পিতামাতার, এটা ঠিক। এটা উদারচিন্তার প্রতিফলন। তাদের ছেলে-মেয়েদের নাম তারাই রাখবে, সমাজ বা সমাজের রীতিনীতি পালন করার দরকার নাই, এটা সবচেয়ে সত্য। তাহলে আরেকটু উদার হলে এটাও ঠিক হবে যে, যদি ছেলে-মেয়েরা বড় হয়ে পিতা-মাতার নামটিকে অপছন্দ করে নিজের মতো নাম রাখতে চায় এবং অপছন্দের নাম রাখার জন্য পিতামাতাদের দায়ী করে, তখন কী হবে?


সবচেয়ে আরও যদি উদার হয়ে যায়, এসব সমাজ, বিশ্বাস, ধর্ম, সংস্কৃতি, চর্চা, প্রথা, রীতিনীতি মানার কোন দরকার নাই, এরকম মনে করে সবকিছু ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়, তাহলে তখন থেকে সে আর মারমা না। তখন থেকে সে আদিবাসী না। কারণ আদিবাসীর সাথে সংস্কৃতির অনেকগুলো অংশ সম্পৃক্ত। 


প্রচলিত বিশ্বাস, রীতিনীতি, চর্চা, ঐতিহ্য, প্রথা না মানলে আমরা মারমা বা আদিবাসী হিসেবে নিজেদেরকে দাবি করব কোন যুক্তিতে?


কলমেঃ মংসাই মারমা, এমএলবি, চবি।

Comments

Popular posts from this blog

প্রাক সুলতানী আমল –মৌর্য বংশ--গুপ্ত বংশ--গৌড় বংশঃ

আইএলও কনভেনশন ১৬৯ এবং জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক ঘোষনাপত্র